রাগ নিয়ন্ত্রণঃ Anger Management

রিদওয়ান বিন শামীম

 

রাগ নিয়ন্ত্রণ বা ব্যবস্থাপনার সারসংক্ষেপ

রাগ হল , এককথায়, কারো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকির প্রতিক্রিয়া। এটি অস্বস্তির মাধ্যমে শুরু হয়ে বিরক্তির উদ্রেক করে, কখনো কখনো সহিংসতারও জন্ম দিতে পারে। রাগকে অনেক সময় আক্রমণাত্মকতার সাথে গুলিয়ে ফেলা হয়। বিরুদ্ধাচরণ, আক্রমণাত্মকতা ও মেজাজ খারাপ এই সবগুলোকেই রাগের আওতায় ধরা হয় যদিও এদের মধ্যে কিছু সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে।

  • বিরুদ্ধাচরণঃ রাগান্বিত মানসিক অবস্থায় পরিস্থিতি সম্পর্কে আমাদের ধারণা ও বিচার বিশ্লেষণ বিরুদ্ধাচরণের জন্ম দেয়। বিরুদ্ধাচরণ আবার আক্রমণাত্মকতার জন্ম দেয় ও একে উৎসাহিত করে।
  • আক্রমণাত্মকতাঃ আক্রমণাত্মকতা হল সেই আচরণ যেটি মানুষের বা সম্পদের ক্ষতি সাধনের চেষ্টা করে। আমাদের ভেতরের ফুঁসে উঠা রাগের চূড়ান্ত পর্যায় হল এই আক্রমণাত্মকতা।
  • মেজাজ খারাপঃ মেজাজ খারাপ হল বিরক্তি ও সহিংস আচরণের মধ্যবর্তী একটি অবস্থা। মানসিক অবস্থা এই ক্ষেত্রে থাকলে তা অন্য সব আবেগকে ছাপিয়ে প্রকাশ পায়। মজার ব্যপার হল, মেজাজ খারাপের ইংরেজি প্রতিশব্দে ব্যবহৃত মুড (mood)শব্দটি এসেছে পুরনো ইংরেজি মুড(mod)থেকে, যার মানে ছিল সাহস।

রাগের বৈপরীত্য

রোহান একটি এপার্টমেন্টে থাকে। প্রতিদিন সকালে উঠে সে দেখে সে তার মোটরসাইকেলটি যেখানে রেখেছিল সেখানে নেই, তাকে না জানিয়ে সেটির স্থান পরিবর্তন করা হয়েছে। তার মনে প্রথম যে অনুভূতিটি আসে তা হল অস্বস্তি, তার ব্যক্তিগত পরিমণ্ডলে অন্য কারো হস্তক্ষেপের কারণে বিরক্তি। এরপর অবশ্যই তার ভেতরে রাগ সৃষ্টি হতে পারে, ‘ আমাকে মানুষই ভাবে না! আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করারও দরকার নেই, তাইতো!’ তার মনে একটি বিরুদ্ধাচরণমূলক প্রতিক্রিয়া জন্ম নিতে থাকে।

যখন রাগে নিজের সাথে রোহান নিজেই কথা বলছে তখন তার ছেলে এসে ফ্যান মেরামত করতে রোহানের সাহায্য চাইল । মনের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে বিরক্ত রোহান ছেলেকে বকাঝকা করল, ছেলে কান্না শুরু করল।এতে করে রোহান ব্যথিত হল এবং সাময়িকভাবে তার রাগ অবদমিত হলেও, ভেতরে ভেতরে ঠিকই সে রেগেই রইল, ভাবতে লাগল, সকালটাই মাটি। অফিসে তার কলিগরাও এটি টের পায় এবং বলাবলি করতে থাকে, ‘আজ রোহানের মেজাজ খারাপ‘।

রাগ নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনাঃ প্রচলিত ধারণা ও বাস্তবতাঃ

রাগ নিয়ে বহুল প্রচলিত অনেক ধারণা আছে, এগুলো তলিয়ে দেখা যাক এবং প্রকৃত বাস্তবতা সম্পর্কেও আলোচনা করা যাক।

  • ১ম প্রচলিত ধারণাঃ রাগ দেখালে তা প্রশমিত হয়, রাগ পুষে রাখা ভাল নয়।
    বাস্তবতাঃ একটি কথা আছে, ‘রাগ পুষে রাখা আর হাতের মধ্যে জ্বলন্ত কয়লা ধরে রাখা একই কথা’। রাগ অবশ্যই প্রশমিত করতে হবে কিন্তু তা আক্রমণাত্মক উপায়ে নয়, কারণ সেটি কেবল সংঘর্ষের প্রবণতাই বাড়াবে।
  • ২য় প্রচলিত ধারণাঃ রাগ অন্যের কাছ থেকে মনোযোগ, সম্মান ও আনুগত্য পেতে সাহায্য করে।
    বাস্তবতাঃ কারো উপর প্রভাব বিস্তার করার ক্ষমতা কাউকে বোঝার দক্ষতা থেকে আসে, তাকে ভয় দেখিয়ে নয়। ধমকাধমকি করে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করলে অধিনস্তরা সম্মান তো করবেই না বরং অন্যের মতামত গ্রহন করতে না পারলে নিজেরই অনেক বড় ব্যবধান রচিত হবে।
  • ৩য় প্রচলিত ধারণাঃ আমি আমার রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না।
    বাস্তবতাঃ অন্য অনেক আবেগের মতই, রাগও আমরা যে পরিস্থিতির ফলাফল। সম্ভাব্য বহুমুখী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করতে পারলে রাগ নিয়ন্ত্রণ ও ভুল বিবেচনা এড়ানো সম্ভব হয়।
  • ৪র্থ প্রচলিত ধারণাঃ রাগ ব্যবস্থাপনা হল রাগ দমন করার পদ্ধতি শেখা।
    বাস্তবতাঃ রাগ দেখিয়ে প্রশমিত করা যায় না, আবার রাগকে অন্য কোন ভাবে দমন করাও যায় না,বরং এটিকে অহিংস কোন উপায়ে বয়ে যেতে দেয়াই ভাল। রাগ ব্যবস্থাপনায় এবিষয়টিই মানুষকে দেখানো হয়।

কেন রাগ নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনা কেন?

দীর্ঘস্থায়ী রাগ মানুষের স্বাস্থ্যের, সামাজিক ও ব্যক্তিগত জীবনেও স্বল্পকালীন ও দীর্ঘমেয়াদী ঝুঁকিতে পরিণত হতে পারে। দৈনন্দিন জীবনে বন্ধুত্ব ও সম্পর্কের ক্ষতি, অবিশ্বাস ও অশান্তিরও কারণ হতে পারে।

রাগ স্বাস্থ্য, চিন্তাজগত ও ক্যারিয়ারের যেসব ক্ষতি করে

দীর্ঘ সময়ের রাগান্বিত মনোভাব আমাদের উপর অনেক চাপ সৃষ্টি করে, শরীরের রিলাক্সেসনের জন্য সেই তুলনায় সময় দেয়া হয় না। এটি উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও ঘুমহীনতা সহ অনেক সমস্যা সৃষ্টি করে। এটি বিচার বিশ্লেষণের ক্ষমতা কমিয়ে ফেলে, মানসিক শক্তি কমিয়ে ফেলে অবসাদ ও দুশ্চিন্তাসহ নানা সমস্যাও সৃষ্টি করতে পারে।কর্মক্ষেত্রে যারা অন্যের মতামত ও দক্ষতার ব্যবধান সহজভাবে মেনে নিতে পারেন না তারা রাগান্বিত আচরণে তাদের মনোভাব প্রকাশ করেন, যেটি বন্ধু ও সহকর্মীদের সাথে তাদের সমস্যা সৃষ্টি হতে সাহায্য করে। অতিরিক্ত রাগ ব্যক্তির সাথে সামাজিক যোগাযোগ ও মেলামেশা কমিয়ে দেয়, অনেক সময় শিশুদের মনোজগতেও নেতিবাচক প্রভাব রাখে।

রাগের লক্ষণ

রাগের মানসিক লক্ষণগুলো হল,

  • অস্বস্তি
  • বিরক্তি
  • অস্থিরতা

রাগের কিছু শারীরিক লক্ষণ আছে, এগুলো হল,

  • হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া
  • পেশী আড়ষ্ট হয়ে যাওয়া
  • কপালে ঘাম জমা।

এই মানসিক ও শারীরিক লক্ষণগুলো মিলে আমাদের কিছু আক্রমণাত্মক আচরণ পরিলক্ষিত হয় যেমন,

  • চেঁচানো, তর্ক করা,
  • জিনিসপত্র ছুঁড়ে ফেলা,
  • দেয়ালে লাথি মারা, বালিশে ঘুষি মারা বা আছড়ে দরজা বন্ধ করা,
  • কান্না করা ইত্যাদি।

তবে সবচে ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া হল কিছু না করা। মনের ভেতর রাগ পুষে রেখে দমন করা। এটি সুরাসক্তি, মাত্রাতিরিক্ত ধূমপান এমনকি মাদকাসক্তির দিকেও মানুষকে নিয়ে যেতে পারে। এসব ক্ষেত্রে নিজেকে এটি বোঝানোই সবচেয়ে ভাল যে, মানুষ, পরিস্থিতি ও পরিবেশ না বরং আমাদের প্রতিক্রিয়া কীভাবে হচ্ছে তার ধরণই রাগের কারণ। মোটকথা, আমাদের যা কিছু রাগাতে পারে, তা আমাদের নিয়ন্ত্রণও করতে পারে।

রাগ ব্যবস্থাপনাঃ রাগের সূত্রঃ

রাগ বোঝা ও অনুধাবন করার চারটি কার্যকর পদ্ধতি আছে যেগুলোর সাহায্যে বৈরী পরিস্থিতিতে আমাদের দেহ মনে রাগের উৎপত্তি বুঝতে পারি ।

  • শারীরিক সূত্রঃ হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া,পেশী আড়ষ্ট হয়ে যাওয়া, শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুত হওয়া এসব হল রাগের শারীরিক সূত্র।
  • আচরণগত সূত্রঃ আমাদের রাগের সময় অন্যে আমাদের যেমন করতে দেখে যেমন চোয়াল শক্ত হয়ে যাওয়া, ভুরূ কোঁচকান, কঠিন দৃষ্টিতে তাকানো এসবই আচরণগত সূত্র।
  • আবেগিক সূত্রঃ লজ্জা পাওয়া,অপরাধবোধ, নিরাপত্তাহীনতা, সাহায্যহীন অবস্থা এসবই রাগের আবেগিক সূত্র।
  • চিন্তা বিষয়ক সূত্রঃ রাগ প্রকাশ করে এমন ঘটনা মনের দৃশ্যপটে আসলে তাকে রাগের চিন্তা বিষয়ক সূত্র হিসেবে ধরা যাবে।

রাগ ব্যবস্থাপনাঃ রাগী আচরণ

নেতিবাচক আবেগের বিশ্লেষণ

নেতিবাচক আবেগের বিশ্লেষণে যে জিনিসগুলো দেখা হয় সেগুলো হল,

  • হীনমন্যতাসূচক ধারণাঃ উদাহরণস্বরূপ, এমন ভাবা যে,’আমাকে কেউ পাত্তা দেয় না, আমাকে ঘৃণা করে’ এসব হীনমন্যতাসূচক ধারণা পোষণ করা।
  • অনমনীয় দৃষ্টিভঙ্গিঃ অন্যের মতামতের প্রতি অনমনীয় দৃষ্টিভঙ্গি রাখা।
  • অপরিনতভাবে ধারণা করা ও সিদ্ধান্তে আসাঃ অপরিনতভাবে ধারণা করা ও সিদ্ধান্তে আসাটা নেতিবাচক আবেগের আরেকটি উদাহরণ।
  • রাগ করার যুক্তি খোঁজাঃ রাগ করার যুক্তি খোঁজা বিরক্তি ও ভুল বোঝাবোঝির সমন্বয়ে হয়ে থাকে।
  • দোষারোপ করাঃ সমস্যা বিষয়ে নিজের ভূমিকা না দেখে অন্যকে দোষারোপ করা নেতিবাচক আবেগের আরেকটি উদাহরণ।

রাগ ব্যবস্থাপনাঃ রাগের চক্র ও এবিসিডি মডেল

রাগের একধরনের চক্র আছে, রাগ উঠা, প্রতিক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া পরবর্তী মানসিক অবস্থা নিয়ে এই চক্র সমন্বিত। রাগ ব্যবস্থাপনার উদ্দেশ্য হল মানুষকে প্রতিক্রিয়ার ক্ষেত্রে না পৌঁছানোর শিক্ষা দেয়া, যাতে প্রশিক্ষণ ও প্র্যাকটিসের মাধ্যমে রাগ উঠার সময়ই সেটি নিয়ন্ত্রণের দক্ষতা অর্জন করা যায়।

ইংরেজিতে এই এবিসিডি মডেলকে এভাবে দেখানো হয়,
A (Activation Agent)
B (Believing)
C (Conclusions)
D (Dispute)

এই প্রতিটি ধাপে মানব মনের গতিপ্রকৃতি নিয়ে আলোচনা করা হয়।

রাগ ব্যবস্থাপনাঃ রাগ নিয়ন্ত্রণ

রাগের কারণ অনুধাবন, সূত্র বিশ্লেষণ ও রাগের এঙ্গার বাটন(Anger Buttons) সনাক্ত করে রাগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা উচিৎ। রাগ দমনের কিছু উপায় হল,

  • গভীরভাবে নিশ্বাস নেয়া
  • ব্যয়াম করা
  • অনুভূতি প্রয়োগ যথা গান শোনা বা শান্ত প্রকৃতির কথা মনে রাখা
  • মনেমনে ধীর গতিতে সংখ্যা গোনা

রাগ নিয়ন্ত্রণের ভাল উপায় খুঁজে বের করা ও পরিস্থিতি সম্পর্কে ধীর মনে অনুধাবন করাও ভাল উপায়।

রাগ নিয়ন্ত্রণ করে যোগাযোগ দক্ষতা বাড়ানোর উপায়

  • অন্যের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনা
  • সরাসরি সিদ্ধান্তে উপনীত না হওয়া
  • সাথেসাথে প্রতিক্রিয়াশীল না হওয়া
  • নিজের প্রকৃত অনুভূতি প্রকাশ করা

এছাড়াও নিজের পুরনো নেতিবাচক চিন্তাভাবনা পরিবর্তন করে ইতিবাচক মানসিকতা অর্জনের চেষ্টা করা উচিৎ।

রাগ ব্যবস্থাপনাঃ কিছু টিপস

রাগ ব্যবস্থাপনার কিছু পরীক্ষিত উপদেশ এরকম,

  • কথা বলার আগে চিন্তা করা
  • শান্তভাবে রাগ প্রকাশ
  • ব্যয়াম করা
  • নিজেকে সময় দেয়া
  • সমাধান সনাক্ত করা
  • বিবৃতিতে ‘আমি’ সত্ত্বা ব্যবহার করা
  • দ্বেষ প্রকাশ পায় এমনভাবে কথা না বলা
  • রসবোধ প্রয়োগ করা
  • সিথিলায়ন অনুশীলন করা
  • রাগ নিয়ন্ত্রণে নিজে ব্যর্থ হলে প্রফেশনাল সাহায্য নেয়া যেতে পারে

 

কিছু উৎস যা তথ্যের সূত্র হিসেবে কাজে লাগতে পারেন

  • Davies, William (2000); Overcoming Irritability and Anger; Constable & Robinson; ISBN: 1854875957
  • Garber, Kathy S (2002); Stop Anger, Be Happy; Trafford; ISBN: 155395095
  • Lindenfield, Gael (2000); Managing Anger; Thorsons Publishers; ISBN: 0007100345

 

 

Permanent link to this article: http://bangla.sitestree.com/%e0%a6%b0%e0%a6%be%e0%a6%97-%e0%a6%a8%e0%a6%bf%e0%a7%9f%e0%a6%a8%e0%a7%8d%e0%a6%a4%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%a3%e0%a6%83-anger-management/

Leave a Reply